বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

Close

Homeফিচারমহামারির প্রভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ

মহামারির প্রভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ

মেয়েদেরও 'সতীত্ব রক্ষার' জন্য ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়া হয়।

দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েদেরও ‘সতীত্ব রক্ষার’ জন্য ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাস মহামারির ফলে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। যার প্রভাবে দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রচেষ্টায় গত এক দশকে বাল্যবিবাহের হার অনেকটা কমে গেলেও, করোনাভাইরাসের ছোবলে মেয়েদের বিয়ে দিলেই অর্থনৈতিক সমস্যা মিটে যাবে মনোভাব নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

বাল্যবিবাহ বা জোরপূর্বক বিয়ে শিশুদের মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই ভয়ংকর রীতিটি শিশুদের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাদেরকে সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়।

মেয়েদের বোঝা মনে করার মানসিকতা

দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েদেরও ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

ইউনিসেফের মতে, দরিদ্র পিতা-মাতা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে, মেয়েরা চাকরি করতে পারবে না, শুধুমাত্র ছেলেরাই পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে।

অন্যদিকে, ধনী পরিবারগুলোর একটি অদ্ভুত বিশ্বাস তারা একটি মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে তাদের সতীত্ব রক্ষা করছে।

ইউনিসেফের একটি নতুন গবেষণা অনুযায়ী, “বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা হচ্ছে বাবা-মায়েরা মনে করেন বয়ঃসন্ধির শুরুতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তারা মেয়েদের যৌন সহিংসতা থেকে রক্ষা করছে।”

১৩ বছর বয়সী একটি মেয়েকে ছয় মাস আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ তার বাবা-মা “তার জীবনযাত্রার খরচ বহন করতে পারছিল না”।

ঢাকা ট্রিবিউনের সাথে কথা বলার সময় মেয়েটির মা জানায়, তার স্বামী কোভিড মহামারির কারণে কোনও কাজ করতে পারছে না। তাই তাদের পাঁচটি সন্তানের ভরণপোষণ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছিল।

“এখন খাওয়ার জন্য একটা পেট কম,” তিনি বলেন।

অন্যদিকে, ১৬ বছর বয়সের আরেকটি মেয়ের মায়ের সাথে বলা বলে জানা যায়, খুব শীঘ্রই তার মেয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে।

তিনি বলেন, “আমার মেয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক তাকে বিয়েই করতে হবে। তাহলে এখন বিয়ে করলে দোষ কোথায়? আমরা অনেকগুলো ভালো পাত্র পেয়েছি, যাদের মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না।”

তিনি আরও জানান, যদি মেয়ের কলেজ খোলা থাকতো তাহলে তারা আরও দুই বছর অপেক্ষা করতো। কিন্তু এভাবে মেয়েকে ঘরে অলস বসে থাকতে দেখতে চান না তারা।

অনেক কিশোরীই একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। কেননা স্কুল বন্ধের কারণে বাবা-মায়েরা তাদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে।

বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দেওয়া অবৈধ হলেও বাল্যবিবাহ রোধ আইন-২০১৭-এর ধারা ১৯ এর বিশেষ বিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)-এর “বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারিকালীন বাল্য বিবাহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ” শীর্ষক একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের ২১টি জেলায় অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫১২ টি বাল্যবিবাহ হয়েছে বরগুনা জেলায়।

“৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রে, বাবা-মায়েরা তাদের আর্থিক অসচ্ছলতাকে মূল কারণ হিসাবে উল্লেখ করে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রচলন শুরু করেছিল।

এই মেয়েদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৬-১৭ বছর, ৪৮% এর বয়স ১৩-১৫ বছর এবং বাকি ২% এর বয়স ১০-১২ বছর,” বলে জানায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

“জাগো নারী” নামে একটি বরগুনা-ভিত্তিক একটি এনজিও’র প্রকল্প সহ-সমন্বয়কারী রাবেয়া মুন্নী বাল্যবিবাহের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসন বা কাউন্সেলিংয়ের সাহায্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত শুধুমাত্র তালতলী উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ২৮৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি।”

তিনি আফসোস করে জানান, তাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১২১টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

তালতলী উপজেলার ইউএনও মো. কাওসার হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, উপকূলবর্তী এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বাড়ছে। বাল্যবিবাহ রোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে কারণ অনেক এলাকাই স্থানীয় প্রশাসনের নাগালের বাইরে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বাল্যবিবাহের প্রধান চারটি কারণের মধ্যে দারিদ্র্য (২৯.৯%), মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া (১৮.৮%), ভালো স্বামী কম বয়সে পাওয়া যায় মনোভাব (১১.৭%) এবং পরিবারের আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে বা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা থাকা (১১.৩৯%) অন্যতম।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সর্বোচ্চ দশটি বাল্যবিবাহের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষে।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫১% যার মধ্যে প্রতি ১০ জনে ৫টি মেয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই এবং প্রতি ১০ জনে ৮ জন ২০ বছর হওয়ার আগেই মা হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছে?

সরকার যেন অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয় এবং সাহায্য প্রদান এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচির ব্যবস্থা করে তেমনটাই পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্র্যাকের প্রোগ্রাম হেড (জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি) সেলিনা আহমেদ বলেন, গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস আসার পর থেকে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের কারণে বাল্যবিবাহ রোধে মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল।

তিনি দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ রাখা ও অভিভাবকদের আর্থিক অসচ্ছলতাকে বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, অনেক গ্রামীণ বাবা-মা এখনও তাদের মেয়েদের বোঝা হিসেবে এবং বিয়ে দিয়ে দেওয়াকেই চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে মনে করে।

সেভ দ্য চিলড্রেন-এর শিশু অধিকার নিয়ন্ত্রণ ও শিশু সুরক্ষা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন অভিভাবকদের উল্লেখ করা কারণগুলোকে “অজুহাত” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, “গ্রামাঞ্চলের বাবা-মায়েদের চূড়ান্ত লক্ষ্যই তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। কারণ তাদের কাছে মেয়ে মানেই বোঝা। যদি স্কুল খোলা থাকতো তাহলে হয়তো তারা এক বছর অপেক্ষা করতো।”

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “আমি নিশ্চিত মহামারির ফলে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াই বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ। গত কয়েক বছরে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছিল এবং একই সাথে বাল্যবিবাহের হারও কমছিল। কিন্তু মহামারির কারণে তা আবারও বেড়ে গেছে।”

আপনার মন্তব্য দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

- Advertisment -
  • সর্বশেষ
  • আলোচিত

সাম্প্রতিক মন্তব্য

স্বঘোষিত মহাপুরুষ on লকডাউন বাড়লো আরও একসপ্তাহ
জান্নাতুল ফেরদৌস on চিরবিদায় কিংবদন্তি কবরীর